স্বপ্ন ছাড়া মানুষ কি বাঁচে? মানুষ কি বাঁচতে পারে? যার আছে সে আরো চায়, যার নেই সেও চায়। এই চাওয়া, পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মানুষকে নিয়ে যায় সামনের দিকে, এক  সৌন্দর্যময় জগতে। যেখানে রঙ বেরঙের ডানা মেলে উড়ে চলে আগামীর স্বপ্ন। হাঁটি হাঁটি পা পা করে একদিন এই স্বপ্ন বড় হবে, জন্ম  নেবে আশার ভীতে আপন যত সুখ! দূর হবে সব দুঃখ বেদনা । আর ঘুছে যাবে জীবন যুদ্ধে না পাওয়ার  সব যন্ত্রণা। নতুন করে আবারো শুরু হবে আরো একটি স্বপ্নাধ্যায় । মাথা উচু করে আবারও পথচলা...!  সাদা  মলাটে বিন্দু বিন্দু রক্তকণা নিয়ে যাবে আবারও স্বপ্নের নব পাহাড় চূড়ায়! কিন্তু সব সময় কি সব চাওয়া পাওয়ার পূরণ হয়? পাওয়া যায় কি পূর্ণ স্বাদ এই এক জীবনে? 
 	 
 জীবনালেখ্যে কল্পলোকের ভাবনারা বারবার জয়ী হতে চায়। ভেঙ্গে দিতে চায় সামনে আসা সব অন্তরায়।  কীলক আঁটে যখন বাস্তবতার দরোজায়,  একফোঁটা আশার দীপ জ্বেলে তখনও মন থাকে অপেক্ষায়। হয়ত একদিন  অন্ধকার ভেদ করে উঁকি দেবে আলো, আনবে ভোর একমুঠো রোদ্দুর। এমনই আলোর আশায় কাঙ্ক্ষিত এ হৃদয়-     
কিন্তু কি আশ্চর্য!  একটা সময় ছিল যখন বালিশে মাথা রেখে তৃপ্তি নিয়ে ঘুমিয়ে যেতাম। গভীর নিদ্রায় হাতড়ে নিতাম সুখের সবটুকু নির্যাস। কচি হাত পা নেড়ে নেড়ে আমাকে আলতো করে ছুয়ে দিত স্বপ্ন দেখার পাখীটা। আগামীকে দেখে আপ্লূত মনে বুকে জড়িয়ে নিতাম তাঁকে। তখন কিন্তু আমার স্বপ্নরা একটুও ছুটে পালাতোনা!  পালাতে চায়তো না।  
এভাবেই বড় হল আমার বুকের ধন।  সহিষ্ণুতা নিয়ে- অন্য এক অচেনা পরিবেশে,অন্য এক  ভুবনে।  সে যত  বড় হয় আমি আমার স্বপ্নের পূর্ণতাকে তত হাতের মুঠোই অনুভব করি।  তাকে হাতে খড়ি দেই আমার প্রিয় ভাষার শুরু করে। সারা পৃথিবীর  সর্বোত্তম আনন্দকে সাথে নিয়ে। কিন্তু তখনও বুঝিনি এ ছিল একান্তই আমার চাওয়া, পাখীটার নয়! স্কুলে যেতেই অ আ ক খ অক্ষরগুলো তার জন্য একরকম বোঝাই হয়ে দাঁড়ায় ! শুরু হল নতুন করে পাঠ। পাশাপাশি আমার অবাধ্য চাপ ‘আমার মুখের কথা জানবে না আমার আত্মজ! পারবো না আমি তাঁর লেখায় তুলে দিতে রক্তঝরা অক্ষর’!  চাপের মুখেই কয়েকটা বছর পাখীটা আওড়ায় প্রিয় কবিতাক্ষর।  ফোকলা দাঁতে  কি সুন্দর ছড়া কাটে “ঐ দেখা যায় তালগাছ ঐ আমাদের গাঁ...ঐখানেতে বাস করে কানা বগীর ছা” অথবা “ আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তাঁর  হাঁটু জল থাকে”  আমার প্রাণের মাঝে টগবগ করে তাপ নেয় জমে থাকা বরফ। অজান্তেই আনন্দোল্লাসে ভিজিয়ে দেয় আমার সন্তানের উড়ে চলার শুভ্র পালক!     
 শত ব্যস্ততার মাঝে দিনে দিনে কখন যেন সবকিছু হয়ে যায় এলোমেলো। সময় বয়ে চলে আসমুদ্র হিমাচল! কিন্তু সেই আধো আধো ছড়া বলা পাখীটা  এখনও সেই একটা জায়গায়ই থেমে আছে!  বিদেশী ভাষা, সংস্কৃতি আর আমার ভাষা ও সংস্কৃতির মাঝে কখন, কেমন করে যেন একটা শক্ত দেয়াল দাঁড়িয়ে আমার দম্ভকে ভেঙে দিতে উদ্যত  হয়!  ভাত মাছের জায়গাগুলো দখল করে নেয় পিঁজা, পাস্তা আর ফাস্টফুডের করাল থাবা। হাতের বদলে কাঁটা চামচ আর ছুরি টুংটাং  করে  বিদ্ধ করে আমার পাললিক মন।  স্রোতের টানে ‘হ্যাপি মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে’ আনন্দে সেলিব্রেট করে, চুমুতে চুমুতে ধোঁয়া উড়ায়  শ্যাম্পেনের গ্লাসে!  আমি দেখতে পাই-আত্মবিশ্বাসের কলকি জুড়ে  অনাহুত আগুনের দহনে  স্বপ্নরা জ্বলে যায়।  আমি? নাকি আমার নিয়তি? কে নেবে এর দায়?  দুর্বল চিত্তে এই আমি দিন গুণে যাই, শত  অনিশ্চয়তায়।   ঠিক এমনই ক্ষণে স্বপ্ন  দেখা তো দূরে থাক, বাস্তবতায়  আমার বেঁচে থাকা হল সীমাহীন দায়। আমি দেরীতে  হলেও বুঝতে পারি এ যে আমারই নীরব পরাজয়! হই বদ্ধ পরিকর! আমি হেরে যেতে দেবনা আমার ভালবাসাকে! মুছে যেতে দেবনা আমার গর্বিত অস্তিত্বকে!   
মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠে  সেই ভয়াল সময়ের  জীবন্ত সব ছবি। মায়ের মুখের বুলি সেদিন কেড়ে নিতে চেয়েছিল!  শাসকরা চেয়েছিল আমি তাঁদের শব্দের বুলি উড়াই। তাদের পদতলে  থাকি মাথা নত করে। কিন্তু সেদিন,  বাংলা অক্ষর গুলোকে পাঁজরে সাজিয়ে লড়েছিল মায়ের সন্তান।  বারুদের সামনে বুক পেতে দিয়ে বর্ণমালার বুনিয়াদ গড়েছিল সবুজ শ্যামল মায়ের কোলে ! এই অক্ষর, এই শব্দ রক্ত দিয়ে কেনা! এই বুনিয়াদী ভাষা আমার রক্তে, সন্তানের রক্তে মিশে আছে । এই গর্বিত পর্চাকে  এভাবে স্মৃতির ফ্রেমে আমি রেখে দিতে পারিনা!
আমার সন্তান প্রজননে বয়ে বেড়াবে বাংলা আর মুখে বলবে এবং কাজেও দেখাবে অন্য কোন ভাষার জাদু, তাতো আমি হতে দিতে পারিনা। আমি নেমে পড়ি নিজেরই সাথে এক নীরব যুদ্ধে।  দাবীগুলো জানিয়ে দেই বিরোধী পক্ষে। আমার ভাষা পড়তে হবে, লিখতে হবে। দেশের মানুষকে ভালবাসতে হবে। আমার সাথে যেতে হবে শিকড়ের কাছে!  বিরোধীতায় সে কামান দাগায় ‘ ইম্পসিবল,  গো টু হেল!’   
 
 আমার ঘুম আর আসেনা! বালিশে মাথা রেখে আমার স্বপ্নরা জোনাকীর মত নিরাশার ফুলকি ছড়ায় চোখের পাতায়।  ধীরে ধীরে নিভে যেতে চায় পরম্পরার সলতে!  ফুলে ফুলে সাজানো শহিদ মিনার  ছেড়ে আমার দিকে ছুটে আসে হাজারও বীর সন্তান। সুন্দর পরিপাটী আমোদ প্রমোদের শহর আমাকে   একবিন্দু শান্তি দেয়না।  হাজার হাজার মাইল দূরের প্রবাসের মখমলের বিছানায়, আজ আর আমি ঘুমাতে পারিনা ।   
আমার দুচোখের কোলে ঘনকালো মেঘ জানান দেয় আমার  দুর্বল হৃদয়ের বারতা। সেই বার্তায় লেখা স্পষ্টতঃ কথাগুলো পড়ে শোনায় আমার খোকা।  আমার পথ্যও কি আমি বলে দেই । এ আমার অন্তিম চাওয়া, তাও তাকে স্মরণ করিয়ে দেই। আমার সন্তান চোখে চোখ রেখে প্রতিদিনের খবরের শিরোনাম বয়ান করে! মায়ের কোলে থাকা সবার, অধরা সব সুখের যুক্তি দেখায়। সেতো খবর রাখে-এইটুকুই ক্ষীণ আলো দেখে স্তব্ধ হয়ে আমি ভুলে যাই আমার পরিবেশ! 
 কি এমন চেয়েছি আমি তোর কাছে?  খুব কি বেশী ছিল আমার চাওয়া? একটা সবুজ গ্রাম,ছোট্ট একটা ঘর । সেই ঘরে থাকবে প্রাথমিক চিকিৎসার সব সরঞ্জাম । গ্রামের মানুষগুলো নিঃশ্বাস নেবে নির্ভরতার। একজন বিদেশ থেকে আসা ডাক্তারের সুচিকিৎসায় -এই অসহায় মানুষগুলো আবারও ফিরে যাবে প্রিয়জনের বাহুতে সার্বিক সুস্থ্যতায়।  
নিজের অজান্তেই মাতৃভাষা, মাতৃভূমি এসব কিছু থেকে আমার প্রজন্ম অনেক অনেক দূরে! আমি অনুধাবন করি এই ভাষা এই ভূমি  এতো শুধু নাড়ীর টানেই ভীত শক্ত করেনা! ভাষা ও কৃষ্টির মধুরতার স্বাদ লুকিয়ে থাকে স্বজনের আন্তরিক সান্নিধ্যে । আর  ভূমির  স্বর্গীয় সুখানুভূতি সেতো কেবল দেশের মাটি আর বাতাসেই ভাসে!  যেটুকু নিয়ে এসেছিলাম মেখে  তা ওতো শুকিয়ে গেছে বহুবছর আগে !  সব কিছুই  ফেলে এসেছি পিছনে...! পরবাসী বাতাস আমার নিঃশ্বাস থেকে সোদামাটির সুবাস মুছে দিতে না  পারলেও, খুব সহজেই মলিন করে দিয়েছে আমার বংশধরের শরীর  থেকে!  আমি আমার আয়নায় নিজেকে আর খুঁজে পাইনা।  
মনে পড়ে কতবার মাটি আমাকে ডেকেছে-  ‘ফিরে আয় আমার বুকে। ও রে আমার ধন তুই ফিরে আয় তোঁর  মাটির টানে’ আমি সেই টান অনুভব করতে পারলেও গুরুত্ব দিতে পারিনি, মিথ্যে মরীচিকার মোহমায়ায়। 
বেলা শেষ হবার আগেই মুখোমুখি হয়েও হেরে গেলাম। ব্যর্থতা আর অভিমানের শেষ চূড়ায় চড়ে একাই  ফিরে এলাম মায়ের কোলে।  শেষ সম্বল অতৃপ্ত বাসনাটুকু সাথে নিয়ে। নাড়ীর ঘা শুকাতে বৃথা চেষ্টায় দুহাতে তুলে নেয় জননী আমায়, বসন্ত আনে শিমুল পলাশের ঘ্রাণে। আমার মনের তরী  ডুবুডুবু করে  দু’নায়ে! আমার চোখের পাতায় একবিন্দু জল দেখা যায়না। কিন্তু আমি কাঁদি! আমি কাঁদি আমার অপুণ্যতায়, আমি বুক ভাসায় আমার সব  আরাধনায়।  
কেমন করে তিনটা বসন্ত গেছে তা কেবল আমিই জানি। অক্ষরে অক্ষরে লিখে রাখি না বলা সব কষ্ট।  আমাকে আবারও স্বপ্ন দেখাতে চায় হাজারো পাখীর ডাক!  নতুন করে বাঁচতে শেখাতে চায় নদীর নির্মল বাতাস। আজকাল ভয়ার্ত এক অনুভূতি কল্পনার মাঝেও তাড়া করে ফেরে আমায়!  
আঁটই ফাল্গুন,আমি ঝিমঝিম দুচোখে মিনারের  পাদদেশে শুন্য হাঁতে দাঁড়িয়ে। বেখেয়ালী,ত্রস্ত মন ফুল আনতে গেছে ভুলে!  ঝাপসা আমার শহীদের  মিনার। মনে মনে  বলি  ‘আজকেই শেষ তোমার খুব কাছে আসার, আর হয়ত হবেনা দেখা। কারন, আমি  হেরে গেছি!  আর তাই আমি যে মাটি হব, মাটির সুখ নেব’।    
বহুদিন ধরে যে ঝড়টা পুষে রেখেছিলাম বুকে, তা আজ ঝড় হাওয়া হয়ে ঝরে পড়ে দুচোখের বাঁটে!  একটা পরিচিত সুখ সুখ অনুভূতি ক্ষণিকের জন্য আমার কষ্টকে থামায়। ‘মা...!’ কি যে সুখ আছে এই  ডাকটার মাঝে তা কেবল আমিই জানি! 
আবারও সেই ডাক ‘মা’ ! এক অন্যরকম শক্তি আছে, আছে পৃ্থিবীর সবচেয়ে  বেশী ক্ষমতা।  বাংলা ভাষার এই একটা মাত্র শব্দে! যে শব্দ হাজারও কথা বলে।  হাজারও ব্যথা ভুলিয়ে দেয়।  যে শব্দের মাধুর্যে ক্ষমা করার ইচ্ছে জাগে বারবার মাতৃত্বের প্রাণে।  একটা হাতের স্পর্শ ! একটা আনন্দমাখা কোমল সুখ। আমি আমার দুহাতের মাঝে তুলে নেই যেন,  সেই ছোট্ট আমার কুঁড়িটাকে-    
‘খোকা, আমার খোকা’ আমার সমস্ত ভাবনার তার ছিড়ে উল্টো বাতাস বইতে শুরু করে!  
‘মাগো আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবনা মা’  
 আমার বুকে মাথা রাখে আমার খোকা। সে ফিরে এসেছে !  আমার ছেলে তাঁর নাড়ির টানে, মায়ের টানে ফিরে এসেছে !  আমার প্রিয় জীবন্ত ফুলটাকে  মিনারে  দাঁড় করিয়ে আমি আমার কথা ফিরিয়ে নেই ‘এটা আমার শেষ আসা নয়, এটা আমার আসার শুরু।  তোমরাইতো  আমার অহংকার। আমি তোমাদেরকে হেরে যেতে দেবনা। এ শুধু আমার নয়, আমার সন্তানেরও অঙ্গীকার’।  
খোকা আমার হাতটাকে শক্ত করে ধরে তার হাতের মুঠোই নেয় উচ্চকিত শীরে... দুজনে তাকিয়ে থাকি সামনে রক্তলাল সূর্যের দিকে।  ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী ...আমি কি ভুলিতে পারি...’গানে গানে মুখোরিত হয় চারিদিক।  কান পেতে শুনি খোকাও সুরে সুর মিলায়!  স্মরণীয় প্রথম প্রভাতে চোখের বিন্দু বিন্দু রক্ত কণায়-  জীবন পায় সুখের আশ্বাস।  বুকভরে আমি অনুভব করি শহীদের শান্তির গভীর তৃপ্ত নিঃশ্বাস...।            
                        
            
            
            
                        
            
            
                        
            
         
        
               
   
    
                    
        
        
            
            
                 ২৭ মে  - ২০১১ 
                                        
                            গল্প/কবিতা:
                            ১২০ টি
                        
                    
            
            
         
     
    
        
বিজ্ঞপ্তি
        এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
    
    
        প্রতি মাসেই পুরস্কার
        
            বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
        
        
            লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
            
                - 
                    
                    
                        প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
                        প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
                     
- 
                    
                    
                        দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
                        প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
                     
- 
                    
                    
                        তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
                     
 
     
    
        
        বিজ্ঞপ্তি
        “নভেম্বর ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ নভেম্বর, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
        প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী